বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

বনেদি বাড়ির দুর্গা পুজোর সাথে জড়িয়ে আছে নানা কাহিনি! আজকের পর্বে নরসিংহ দাঁ -এর বাড়ি

০৮:০৯ পিএম, সেপ্টেম্বর ২৭, ২০২১

বনেদি বাড়ির দুর্গা পুজোর সাথে জড়িয়ে আছে নানা কাহিনি! আজকের পর্বে নরসিংহ দাঁ -এর বাড়ি

সুব্রত ঘোষ: আগের পর্বে বলেছি কলুটোলায় বদন রায়ের বাড়ির দুর্গাপুজোর কথা। এবারে আসছি জোড়াসাঁকোয় নরসিংহ দাঁ-এর বাড়ির ( বন্দুক বিক্রেতা ) পূজোর কথায়।

আরও পড়ুনঃ বনেদি বাড়ির দুর্গা পুজো – বদন চন্দ্র রায়ের বাড়ি

কলকাতার অন্যতম প্রাচীন ও বনেদি এই বাড়ির ঠাকুরদালানও কিন্তু আমাদের চেনা বনেদি বাড়ির কাঠামোগুলি থেকে আলাদা। এখানে ঠাকুরদালান আর তার সামনের উঠোনের এলাকা কিন্তু বেশ ছোট । আর হয়ত সেই কারণেই এই বাড়ির দালান একটু ভিন্ন রীতিতে তৈরি । এখানে ঠাকুরদালান তিন খিলানের – কিন্তু সেই খিলান তৈরিতে ইট বা সিমেন্টের বড় থাম ব্যবহার করা হয়নি। তার বদলে লোহার কারুকার্য করা থাম আর খিলান – একদিকে যেমন ছোট জায়গার উপযোগী করে তৈরি করা হয়েছে – তেমনই তাতে লেগেছে নান্দনিকতার ছোঁয়া । ইটের থাম আছে ঠাকুরদালানে ওঠার মুখে – কিন্তু সেই দালানও অন্য অনেক বাড়ির মত উঁচু নয়, তাই সিঁড়ি দিয়ে উঠতে হয় না। উঠোন থেকে সহজেই সেই দালানে ওঠা যায়। আবার সেই ছোট দালানটিও ঝাড়বাতি, মুল্যবান আয়না, ছবি, হরিণের সিং দিয়ে সাজানো। তার পরেই ঐ লোহার তৈরি খিলান – দেবী দুর্গার অধিষ্ঠান সেই খিলান পেরিয়ে আরেকটি উঠোনের মত প্রশস্ত জায়গায়।

[caption id="attachment_33677" align="aligncenter" width="1280"]আজকের পর্বে নরসিংহ দাঁ -এর বাড়ি আজকের পর্বে নরসিংহ দাঁ -এর বাড়ি[/caption]

এবারে আসি দুর্গাপূজোর কথায়। এই বাড়ির পূর্বপুরুষ বাঁকুড়া জেলার কোতুলপুর থেকে কলকাতায় এসেছিলেন ব্যবসার সূত্রে। প্রথম দিকে এঁরা মশলার ব্যবসা করলেও পরের দিকে চলে যান বন্দুক এবং অস্ত্রের ব্যবসায় – এবং সেই ব্যবসাতেই তাঁদের প্রচুর ধনবৃদ্ধি ঘটে। কলকাতার দুটি বিখ্যাত বন্দুকের দোকান এন সি দাঁ অ্যান্ড কোম্পানি আর এ টি দাঁ এন্ড কোম্পানির প্রতিষ্ঠা করেন এই বংশের অন্যতম বিখ্যাত পুরুষ নরসিংহ দাঁ। বন্দুক ছাড়াও আরও নানা ধরনের অস্ত্র এঁরা বিক্রি করেন। সত্যজিত রায় তাঁর “ শতরঞ্জ কে খিলাড়ি “ সিনেমার জন্য তরোয়াল এঁদের কাছ থেকেই নিয়েছিলেন। বন্দুক ব্যবসার পরিবার বলেই হয়ত এঁদের শিকারেরও শখ ছিল এক সময়, আর তাই হয়ত বাড়িতে বিভিন্ন জায়গায় বেশ কিছু হরিণের শিং লাগানো আছে দেওয়ালে। পরিবারের এই বিখ্যাত পূর্বপুরুষ নরসিংহ দাঁ-ই এই বাড়ির দুর্গাপূজোর সূচনা করেন ১৮৫৯ সালে । রথযাত্রার দিন বাড়ির দুর্গাদালানে একটি গরান কাঠকে পূজো করে দুর্গাপূজোর সূচনা হয়।

[caption id="attachment_33679" align="aligncenter" width="1280"]আজকের পর্বে নরসিংহ দাঁ -এর বাড়ি আজকের পর্বে নরসিংহ দাঁ -এর বাড়ি[/caption]

তারপর ধীরে ধীরে সেই কাঠটিকে কেন্দ্র করেই বাঁশ, বেত, খড়, মাটির মধ্যে দিয়ে একদিন মৃন্ময়ী প্রতিমা গড়ে ওঠে। মহালয়ার পরের দিন, প্রতিপদ তিথিতে দেবীর বোধন শুরু হয়। বৈষ্ণবমতে পূজো বলে – সেইদিন থেকেই পরিবারের সকলে নিরামিষ খাওয়া শুরু করেন এবং নবমীর হোম আর শান্তিজলের পর আবার তাঁরা মৎস্যমুখ করেন। মহাষষ্ঠীর সন্ধ্যায় অধিবাস, বরণ, ও বোধনের মধ্যে দিয়ে দেবী পূজোর সূচনা হয়। সপ্তমীর সকালে নবপত্রিকাকে স্নানের পর দুটি বড় প্রদীপ জ্বালানো হয় – একটি তেলের আর একটি ঘিয়ের। প্রদীপ দুটি জ্বলতে থাকে একটানা দশমী অবধি – বিসর্জনের জন্য মায়ের যাত্রা শুরু হওয়া অবধি। মহাষ্টমীর দিন হয় ধুনো পোড়ানো অনুষ্ঠান আর সন্ধিপূজোর সময় জ্বালানো হয় ১০৮ টি প্রদীপ। ভোগ হয় এক মন চাল দিয়ে। নবমীর দিন হয় কুমারী পূজোর অনুষ্ঠান। একজন ব্রাহ্মণকন্যাকে দেবীজ্ঞানে পূজো করার পাশাপাশি বাড়ির কুমারী কন্যাদেরও সাজিয়ে সেখানে বসানো হয়। বিজয়া দশমীর দিন পরিবারের সদস্যরা সকালে বেলপাতা বা কলাপাতায় দুর্গা নাম লিখে মায়ের চরণে নিবেদন করেন । দুপুরে দেবীবরণ আর সিঁদুর খেলার পরে প্রতিমাকে বাড়ির বাইরে এনে সাতপাক ঘোরানো হয় । তারপর নিরঞ্জনের জন্য নিয়ে যাওয়া হয় গঙ্গায়। এই সব ছাড়াও আরও বেশ কিছু নিয়ম আছে এই বাড়ির পূজোয়। যেমন – এ বাড়িতে মায়ের ভোগের জন্যে যে মিষ্টি তৈরি হয় – মূলত – গজা, পান্তুয়া, মিহিদানা আর চন্দ্রপুলি – সেগুলি সব তৈরি হয় এই বাড়িতেই, বাইরের কোন দোকান থেকে কেনা হয় না ।

[caption id="attachment_33676" align="aligncenter" width="1280"]আজকের পর্বে নরসিংহ দাঁ -এর বাড়ি আজকের পর্বে নরসিংহ দাঁ -এর বাড়ি[/caption]

সপ্তমীতে গঙ্গা থেকে কলা বৌ স্নান করিয়ে নিয়ে আসা হয় প্রায় ৮০ কেজি ওজনের রূপোর ছাতার আচ্ছাদনের মধ্যে দিয়ে । পুরো পূজোর সময় জুড়ে পরিবারের ছোট্ট শিশু থেকে বয়স্ক মানুষেরা অবধি সবাই শুধু সিল্কের পোষাকই পরেন। এ ছাড়া মাকে বহুমূল্য সব সোনার গয়না পরানো হয় । সেই সব গয়নার মধ্যে থাকে – মায়ের গলার জন্য – চিক, সীতাহার, সাতনলি হার, হাতের জন্য – বাউটি, চুড় আর বালা, কানের জন্য কানপাশা, আর নাকের জন্য নথ। এছাড়া এমনকি অসুর আর সিংহকেও অলঙ্কার পরানো হয়। এই গয়নাগুলি সেই শুরুর সময় থেকে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরেই চলে আসছে পরম্পরা হিসেবে। প্রতি বছর রথযাত্রার সময় যখন মূর্তি গড়া শুরু হয়, তখনই গয়না গুলিকে নতুন করে পালিশ করা হয়। মায়ের সাজের সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই বিজয়ার দিনে বাড়ির মহিলারা সেজে ওঠেন তাঁদের বিয়ের সময়ের বেনারসী পরে – সেই সঙ্গে পরেন গা ভর্তি গয়না। এ ছাড়া আরও একটি সুন্দর প্রথা আছে এঁদের । পূজোর যাবতীয় কার্যকলাপ শুরু হওয়ার আগে, মাকে যে চৌকিতে বসানো হয় – তার তলায় ভিজে মাটিতে মটর, ছোলা এসব ছড়িয়ে দেওয়া হয়। মা যখন বিদায় নিয়ে যান – তখন সেগুলি থেকে নতুন অঙ্কুর ফুটে বেরোয়। দর্শনটা এই, যে – মা যেতে যেতেও নতুন করে প্রাণ সঞ্চার করে দিয়ে যান। এ ছাড়া বাড়িটি বন্দুক ও অস্ত্র ব্যবসায়ের জন্য বিখ্যাত বলে বন্দুকেরও একটি বিশেষ ভূমিকা থাকে এই পুজোয়। নবপত্রিকা স্নানের পরে কলা বউএর সাথে থাকেন চারজন সশস্ত্র প্রহরী । সন্ধিপুজোর সুচনা হয় তোপধ্বনির মধ্যে দিয়ে। আবার বিসর্জনের দিনেও দেবীকে বিদায় জানানো হয় অনেকগুলি বন্দুকের আওয়াজের গান-স্যালুটের মধ্যে দিয়ে। এক কথায় – এই পূজোর প্রতিটি পর্যায়েই বনেদিয়ানার সঙ্গে জুড়ে থাকে জাঁকজমকের জমকালো ব্যাপার।

ছবিঃ সুব্রত ঘোষ লেখাঃ সুব্রত ঘোষ