শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

কোথায়, কোন প্রেক্ষাপটে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ‍‍`বন্দেমাতরম‍‍` রচনা করেছিলেন? জানুন অজানা এক কাহিনী

শ্রেয়সী দত্ত

প্রকাশিত: এপ্রিল ১৭, ২০২২, ১০:৫৯ পিএম | আপডেট: এপ্রিল ১৮, ২০২২, ০৫:২৩ এএম

কোথায়, কোন প্রেক্ষাপটে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ‍‍`বন্দেমাতরম‍‍` রচনা করেছিলেন? জানুন অজানা এক কাহিনী
কোথায়, কোন প্রেক্ষাপটে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ‍‍`বন্দেমাতরম‍‍` রচনা করেছিলেন? জানুন অজানা এক কাহিনী

অষ্টাদশ শতাব্দী। রাত নিশুতি। জন মানব হীন গঙ্গার পাড়ে প্রকান্ড বাড়িটা যেন ভীষন একা। চারিপাশে বাঁশ ঝাড় আর আম কাঁঠালের উষ্ণতা। দূরে একটানা ঝিঁ ঝিঁ-র ডাক। কোথাও আবার মাঝে মধ্যে শেয়াল ডেকে উঠছে। গ্রাফিক থামের আড়াল দিয়ে বারান্দায় এক ছিলতে কূপির আলো এসে পড়েছে। দমকা বাতাসে দারজা ফাঁক হতেই তিনি। তিনি শহরের ডেপুটি ম্যাজিসেট্রট। শালটা গায়ের ওপর ফেলা। মাথা নিচু করে একটা ছোট্ট টেবিলে তিনি লিখে চলেছেন। রচিত হচ্ছে আগামী ভারতের স্বাধীনতার বীজ মন্ত্র। তাঁর উপন্যাসের চরিত্র মহেন্দ্রর সন্মুখে ভবানন্দ গাইছেন সেই বিখ‍্যাত সঙ্গীত,
                      ‍‍  "বন্দেমাতরম্
                        সুজলাং সুফলাং
                        মলয়জশীতলাং
                         শস‍্যশ‍্যামলাং
                         মাতরম্।"

উপন্যাস টি ‍‍`আনন্দ মঠ‍‍`। শহরটি আজকের চুঁচুড়া।।কিন্তু এই গানের সাথে এই শহরের কি সম্পর্ক? আসলে এই গানের স্রষ্টার সঙ্গে এই শহরের নিবিড় সম্পর্ক। শহরের এক নামী কলেজ থেকে পাশ করে ব্রিটিশ আধিপত‍্যে হুগলী জেলার ডেপুটি ম‍্যাজিস্ট্রেট হয়ে ফিরে এসেছিলেন জেলা সদরে। তিনি আর কেউ নন, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। যাতায়াতের অসুবিধার দরুন থাকতেন গঙ্গাপাড়ের আঢ‍্য বাড়িতে । আর এই বাড়িতে বসেই সৃষ্টি করলেন তৎকালীন ভারতের সামাজিক অবস্থার পটভূমিতে ‍‍`আনন্দমঠ‍‍` উপন‍্যাস।

সংস্কৃতে রচনা করলেন দেশের জাতীয় সঙ্গীত । এবং এই শহরকে দিলেন তার অতীত কে নিয়ে গর্ব করার মতো আরও একটি বিষয়। এই শহরের অলিতে গলিতে ছড়িয়ে আছে ইতিহাস, রন্ধ্রে রন্ধ্রে আছে আভিজাত‍্য। এই শহর জেলার প্রাণকেন্দ্র । জেলার নাম হুগলী। এই জেলার পূর্বদিক দিয়ে বইছে ভাগীরথী। পশ্চিমে মেদিনীপুর ও বাঁকুড়া। ভাগীরথী ছাড়াও বয়ে চলেছে সরস্বতী, কুন্তী, বেহুলা, মুন্ডেশ্বরী,দামোদর ইত‍্যাদি। এবং সমৃদ্ধ করে চলেছে জেলাকে প্রতিনিয়ত।

জেলার প্রায় প্রতিটি অঞ্চলেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে বিভিন্ন সভ‍্যতার ঐতিহাসিক নিদর্শন। যা আজও অম্লান ভাবে বহন করে চলেছে ইতিহাসকে। আর তা আমাদের অতীত কে জানতে সাহায‍্য করে। হুগলী জেলারই সদর শহর হলো চুঁচুড়া। বাংলার ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে যে শহরের ঐতিহাসিক মূল‍্য যথেষ্ট। ১৫৭৯ খ্রী. মুঘল সম্রাট আকবরের রাজত্বকালে পর্তুগিজরা তার অনুমতিক্রমে হুগলী নদীর পশ্চিমতীরে ব‍্যাবসা-বাণিজ‍্যের অন‍্যতম প্রধান ঘাঁটি হিসাবে এই শহর পত্তন করে। তৎকালীন বাংলার প্রধান বন্দর হিসাবে এই শহর পরিচিত ছিল। তাই এই শহরে আজও সওদাগর প্রজাতির মানুষের বাস বেশি । এরপর থেকে একের পর এক বৈদেশিক শক্তি ব‍্যবসার উদ্দেশ‍্যে চুঁচুড়া শহরে উপনিবেশ গড়েছে। পর্তুগিজ, ডাচ, আর্মেনিয়ান অতঃপর ব্রিটিশ শক্তি।

আজও শহরের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে রয়েছে এই সমস্ত ঔপনিবেশিক শক্তির স্মৃতি নিদর্শন। এর মধ‍্যেই বেঁচে রয়েছে পুরাকালের ঐতিহ‍্য। শহরের সবচেয়ে আকর্ষণীয় সৌধ হলো ঘড়ির মোড়ের ঘড়িটি। মহারাণী ভিক্টোরিয়ার জ‍্যেষ্ঠো পুত্র অ্যালবার্ট এডওয়ার্ডের সম্মানে ১৯১৪ সালে নির্মিত এই ঘড়িটি এক অনবদ‍্য শিল্পকর্ম। এছাড়াও উল্লেখ‍্য ২৭৫ মিটার দীর্ঘ চুঁচুড়া আদালত টি যা আগে ছিল ব্রিটিশ ব‍্যারাক ও পশ্চিমবঙ্গের দীর্ঘতম বাড়ি।

ডাচরা উপনিবেশ গড়ার পরপরই তৈরী করেছিল গুস্তাভাস দুর্গ। যা ছিল ওলন্দাজ সৈন‍্যদের ব‍্যারাক। বর্তমানে ভগ্নপ্রায় এই দুর্গটি ‍‍`হুগলী মাদ্রাসা‍‍`র অন্তর্গত। এবং কামানগুলি সংরক্ষিত আছে চুঁচুড়া পুলিশ লাইনে। গঙ্গার তীরে অবস্থিত বর্ধমান বিভাগের কমিশনারের বাড়িটি অতীতে ছিল ডাচ গভর্ণরের বাড়ি। শহরের আরও একটি দ্রষ্টব‍্য স্থান হলো ষণ্ডেশ্বর মন্দির। প্রায় চারশত বছর পুরোনো এই মন্দিরটি নির্মাণ করেন দিগম্বর হালদার। ডাচ গভর্ণর ওভারডেক ষণ্ডেশ্বরকে যে পিতলের ঢাক উৎসর্গ করেছিলেন বিশেষ বিশেষ উপলক্ষ‍্যে তা আজও বাজানো হয়।

এছাড়া এই শহরেই রয়েছে ১৭৫৪ সালে নির্মিত দেশের সর্বাপেক্ষা প্রাচীন আর্মেনীয় গির্জাটি। ১৮৮৫ সালে শহরের ঐতিহ‍্যে নতুন পালক যোগ হয়। মহারাণী ভিক্টোরিয়ার রাজত্বের সুবর্ণ জয়ন্তী উপলক্ষ‍্যে লর্ড ডাফরিন হুগলী ঘাট ও গরিফা সংযোগকারী জুবিলি ব্রিজ নির্মাণ করেন। বর্তমানে পুরোনো ব্রিজটিকে অবিকল রেখেই কিছু সংস্কার করা হয়েছে।