শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

দু’চোখে আঁধার! সংসার চালাতে লোকাল ট্রেনে গান মালতির! তাঁর লড়াইকে কুর্নিশ নিত্যযাত্রীদের

চৈত্রী আদক

প্রকাশিত: জুলাই ২২, ২০২২, ০৬:১৬ পিএম | আপডেট: জুলাই ২৩, ২০২২, ০৯:৩৭ পিএম

দু’চোখে আঁধার! সংসার চালাতে লোকাল ট্রেনে গান মালতির! তাঁর লড়াইকে কুর্নিশ নিত্যযাত্রীদের
দু’চোখে আঁধার! সংসার চালাতে লোকাল ট্রেনে গান মালতির! তাঁর লড়াইকে কুর্নিশ নিত্যযাত্রীদের

নিজস্ব প্রতিবেদনঃ ‘আলোকের এই ঝর্ণাধারায় ধুইয়ে দাও’, মালতির প্রতিটি সকাল শুরু হয় এই গান দিয়েই।‌ শৈশব থেকেই চোখে দেখতে পান না। তার উপরে সংসারে নিত্য অভাব। তাই সংসারের হাল ধরতে হাতে তুলে নিয়েছেন সাউন্ড সিস্টেম। প্রতিদিন এভাবেই লোকাল ট্রেনে গান গেয়ে উপার্জন করেন মেমারির মালতি। তাঁর দরদী কন্ঠে এই গান মুগ্ধ করে নিত্যযাত্রীদের।

মেমারির দলুইবাজার ২ গ্রাম পঞ্চায়েতের ডিভিসি ক্যানেল পাড়ের বাসিন্দা মালতি টুডু। দিদি মঙ্গলি টুডু ও মা বরনী টুডুকে নিয়ে দু’কামরার একটি ছোট্ট ঘরেই তাঁর বাস। শৈশব থেকে দুই বোনই অন্ধ। মাও অসুস্থ। এমনকি হাঁটা-চলার ক্ষমতাও হারিয়েছেন তিনি। শারীরিক প্রতিবন্ধকতা থাকলেও ছোট থেকেই দুই বোনের পড়াশোনার প্রতি প্রবল ঝোঁক।

ক্লাস এইট পর্যন্ত বর্ধমান শহরের ব্লাইন্ড অ্যাকাডেমিতে পড়াশোনা করেন দু’জনে। এরপর মালতি ভর্তি হন বড়শুলের সিডিপি হাই স্কুলে এবং দিদি মঙ্গলি ভর্তি হন বেহালা ব্লাইন্ড স্কুলে। স্কুল জীবন শেষ করে মঙ্গলি ভর্তি হন বর্ধমান উদয়চাঁদ মহিলা কলেজ। মঙ্গলির যখন গ্র্যাজুয়েশনের ফাইনাল ইয়ার তখন মালতির সামনেই উচ্চ মাধ্যমিক। হঠাৎই এর মাঝে নেমে আসে বিপর্যয়। ব্রেন স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে মারা যান তাঁদের বাবা।

এই অবস্থাতেও মনের জোরে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেন মালতি। ভর্তি হন বিবেকানন্দ কলেজে। এর পাশাপাশি ছ’মাসের কম্পিউটার কোর্সও সম্পূর্ণ করেন। কিন্তু গ্র্যাজুয়েশনের পড়াশোনা শেষ করতে পারেননি মঙ্গলি। স্বামীকে হারিয়ে ধীরে ধীরে অসুস্থ হয়ে পড়তে শুরু করেন বরনী দেবীও। হারাতে থাকেন কাজ করার ক্ষমতা। সংসারে দেখা দেয় প্রবল অর্থাভাব। দুই বোনের মানবিক ভাতা এবং মায়ের বার্ধক্য ভাতা সহ মোট ৯ হাজার টাকাতে কোনওরকমে চলতে থাকে সংসার।

এই প্রসঙ্গে মঙ্গলি জানান, “দুচোখে দেখতে না পাওয়ার কারণে যাওয়া আসায় সমস্যা ছিল। বাবা দিনমজুরের কাজে গেলে মা আমাদের সাহায্য করত। আবার মাও কাজ করে সংসারে সাহায্য করত। বাবা মারা যাওয়ায় আমরা একা হয়ে যাই। পড়াশোনা ছেড়ে দিতে বাধ্য হই। এখন ঘরের কাজ আর মাকে দেখাশোনা করি।”

শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও হার মানেননি মালতি। ছোটবেলায় ব্লাইন্ড অ্যাকাডেমিতে পড়াশোনার পাশাপাশি রবীন্দ্রসঙ্গীতও শিখেছিলেন তিনি। বড় হয়ে সেই শিক্ষাই কাজে লাগে। বন্ধু রূপচাঁদ মুর্মু সুর রেকর্ড করে দেন। এরপর তাঁকে সঙ্গে নিয়েই ক্যারাওকে সাউন্ডে মেমারি থেকে বর্ধমান লোকালে গান করা শুরু করেন মালতি। এটাই এখন তাঁর পেশা। প্রতিদিন সকাল সাড়ে সাতটার ট্রেন ধরেন এবং বিকেল পর্যন্ত গান করেন তিনি। দিনে গড়ে আয় করেন ৩০০ টাকা।

মালতির কথায়, “ঘরে অভাব আছে। কিন্তু সেটা ভেবে বসে থাকলে চলবে না। তাই গানকেই বেঁচে থাকার রসদ করে নিয়েছি। গান গেয়ে আনন্দ পাই, সবাই হাততালি দেয়, পয়সা দেয়। মন আর পেট দুটোই ভরে যায়।” তিনি জানিয়েছেন, গান গেয়ে উপার্জনের টাকা দিয়েই রেল, স্টাফ সিলেকশন কমিশনের ফর্ম ফিলআপ করেছেন। যদি সরকারি চাকরি মেলে তো ভালো না হলে গানকেই তিনি পেশা বানাতে চান।

মালতি আরও জানান, “আমাদের জন্য যে সরকারি সুবিধা আছে অনেক কারণে সেগুলি পাওয়া যায়নি। সেগুলি পেলে ভালো হয়। আর কিছু চাই না। চাকরি পেলে ভালো না হলে ট্রেনের পাশাপাশি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গান গেয়ে যেতে চাই।” জীবনে কঠিন বাধা-বিপত্তির সম্মুখীন হলেও থেমে থাকতে চান না মালতি। সমস্ত প্রতিকূলতাকে অতিক্রম করে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে চান। গাইতে চান জীবনের জয়গান।

এই বিষয়ে বর্ধমান ব্লাইন্ড অ্যাকাডেমির ডিরেক্টর রায়চাঁদ সুরানা বলেছেন, “খুব ছোট বয়সে মালতি আমাদের এখানে আসে। গান শেখে, পড়াশোনা করে। কিছু না পেয়ে বিপথে চালিত না হয়ে যেভাবে গানকে বেছে নিয়েছে তাতে আমার গর্ব হচ্ছে। ওদের যে কোনও সাহায্যে আমি আছি।” এই প্রসঙ্গে বক্তব্য রেখেছেন বড়শুল সিডিপি স্কুলের প্রধান শিক্ষক রামচন্দ্র সরেন। বলেছেন, “মালতি ছোট থেকে ভালো গান গাইত। স্কুলের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গান করত। ওদের অবস্থা শুনে খারাপ লাগছে। তবে যেভাবে ও গানকে বেঁচে থাকার রসদ করেছে সেটা অন্যদের প্রেরণা দেবে।” তাঁর লড়াইকে কুর্নিশ জানিয়েছেন মেমারির বিধায়ক মধুসূদন ভট্টাচার্য। বলেছেন, “পরিবারটি সম্পর্কে জানলাম। কীভাবে সাহায্য করা যায় সেটা খতিয়ে দেখব।”