শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

রিভলভার পাচার করে পুলিশের নজরে, ‍‍`ভারত ছাড়ো‍‍` আন্দোলনেও সামিল ছিলেন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়

মৌসুমী মোদক

প্রকাশিত: আগস্ট ২৬, ২০২২, ০৬:৩৫ পিএম | আপডেট: আগস্ট ২৭, ২০২২, ১২:৩৫ এএম

রিভলভার পাচার করে পুলিশের নজরে, ‍‍`ভারত ছাড়ো‍‍` আন্দোলনেও সামিল ছিলেন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়
রিভলভার পাচার করে পুলিশের নজরে, ‍‍`ভারত ছাড়ো‍‍` আন্দোলনেও সামিল ছিলেন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়

তিনি ছিলেন বাংলা কৌতুক সাম্রাজ্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সম্রাট। তাঁর হাস্য-কৌতুকের মোহে আজও মজে আপামর বাঙালি৷ ‘মাসিমা মালপো খামু…’ তাঁর এই একটি সংলাপ আজও অমলিন বাঙালির মনে। আসল নাম সাম্যময় বন্দ্যোপাধ্যায় হলেও বাঙালি তাঁকে চেনে ‍‍`ভানু‍‍` নামেই। বাংলা চলচ্চিত্র জগতে তাঁর অবদানের কথা প্রায় সকলেরই পরিচিত। আজ তাঁরই ১০২তম জন্মবার্ষিকী।

যার হাত ধরে বাংলা চলচ্চিত্রের কৌতুকরসের সঙ্গে বাঙালির পরিচয়, জানেন কি একসময় পুরোদস্তুর এক স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন তিনি? এমনকি ‍‍`ভারত ছাড়ো‍‍` আন্দোলনের সক্রিয় সদস্যও ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়। একসময় রিভলভারও পাচার করেছেন। যার জেরে পুলিশি নজরেও পড়তে হয়েছিল। সেই তিনিই পরে হয়ে ওঠেন বাংলা চলচ্চিত্র জগতের অন্যতম কিংবদন্তি এক কৌতুকাভিনেতা।

 ১৯২০ সালের ২৬ অগাস্ট বাংলাদেশের মুন্সীগঞ্জ জেলার বিক্রমপুরে জন্ম ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের। সেই কৌশোর থেকেই স্বাধীনতা আন্দোলনে হাতেখড়ি শুরু। মাত্র ১২ বছর বয়সেই বৈপ্লবিক কর্মকান্ডে  জড়িয়ে পড়েন ভানু। বিপ্লবী দীনেশ গুপ্ত ও  বিপ্লবী অনন্ত সিংহকে গুরু মানতেন৷ তাঁদের কাছেই সংগ্রামের প্রথম পাঠ । সেসময় গোপনে বিপ্লবী বই, প্রচারপত্র পাচার করার কাজে যুক্ত ছিলেন ভানু। এমনকি এক জায়গা থেকে অন্য এক জায়গায় রিভলভার পাচারও ছিল তাঁর কাজ। 

ব্রিটিশদের হাতে দীনেশ গুপ্তের মৃত্যুর হলে ঢাকার অনুশীলন সমিতিতে যোগ দেন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়। সেসময় আশেপাশে ‍‍`ভারত-ছাড়ো‍‍` আন্দোলনের ঢেউ। অনুশীলন দলের একাংশের উদ্যোগে তৈরি হল বামপন্থী আরএসপি দল। ভারত ছাড়ো আন্দোলনে সেই দলের সঙ্গে যোগ দিলেন ভানুও। তখনই পুলিশি নজরে পড়েন তিনি। তবে পুলিশের খাতায় নাম থাকলেও গ্রেপ্তারির হাত থেকে বেঁচে যান। এরপর তাঁর নামে হুলিয়া জারি হলে ভানু তখন চলে আসেন কলকাতায়। 

কলকাতায় এসেই প্রথমে তিনি চাকরি নিলেন আয়রন এন্ড স্টিল কোম্পানিতে। এরপর  অভিনয় শিল্পী হিসাবে প্রথম আত্মপ্রকাশ ১৯৪৬ সালে। চন্দ্রগুপ্ত নাটকে চাণক্যের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন  ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়। সেসময়ই ধীরে ধীরে চলচ্চিত্র জগতে প্রবেশ তাঁর। ১৯৪৭ সালে মুক্তি পায় ভানুর প্রথম ছবি ‘জাগরণ’। এরপর ১৯৫৩ সালে মুক্তি পাওয়া ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ ছবির মাধ্যমেই বাংলা ছবির জগতে নিজের জায়গা পাকা করে ফেলেন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়। এরপর ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে ছবির সংখ্যা। ‘মন্ত্রমুগ্ধ’(১৯৪৯), ‘বরযাত্রী’(১৯৫১), ‘পাশের বাড়ি’(১৯৫২), ‘বসু পরিবার’(১৯৫২), ‍‍`সাড়ে চুয়াত্তর‍‍`(১৯৫৩) ইত্যাদি ছবিতে নিজের অভিনয়ের জাত চেনান ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়। এরপর ১৯৫৮ সালে মুক্তি পাওয়া দু’টি উল্লেখযোগ্য সিনেমা হল ‘ভানু পেল লটারি’ এবং ‘যমালয়ে জীবন্ত মানুষ’-এর মাধ্যমে দর্শকের মনে চিরস্থায়ী জায়গা করে নেন কোতুক সম্রাট।

অভিনয়ের পাশাপাশি নিজের সংগ্রামী মনোভাবকে কোনওদিনই হারিয়ে যেতে দেননি ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়। অভিনয় জীবনে কখনও অন্যায়ের সঙ্গে আপস করেননি। কলাকুশলীদের সংগঠন বা বিভিন্ন অন্যায়ের বিরুদ্ধে ধর্মঘট, প্রযোজকদের একচেটিয়া আধিপত্যের বিরুদ্ধে বারবার রুখে দাঁড়ানো, ইত্যাদি কারণে খ্যাতির শীর্ষে থাকাকালীন টানা বেশ কিছু বছর কাজ পাওয়া থেকে বঞ্চিত হতে হয় তাঁকে। একটা সময় বছর পাঁচেক তাঁকে ব্ল্যাক লিস্ট করে দেওয়া হয় এই কিংবদন্তি অভিনেতাকে৷ সেই সময়টুকু তিনি জলসা, থিয়েটার বা বিভিন্ন কৌতুক অভিনয়েই মন দিয়েছিলেন। তবে কিছুতেই হাল ছেড়ে দেননি। আপস না করেও মাথা নীচু করেননি কোনওদিনই। 

আসলে শত কষ্টের মধ্যেও তাঁর মুখে লেগে থাকতো হাসির ছোঁয়া। আর এভাবেই দর্শকের মনের মণিকোঠায় আজও বিরাজমান ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়। বাংলা চলচ্চিত্রে তাঁর অভিনয় যেমন চিরকাল অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে, তেমনই আপামর বাঙালির মনেও অমর এই কিংবদন্তি কৌতুক সম্রাট। আজ বাংলার হাস্যরসের একচ্ছত্র এই রাজার জন্মদিনে তাঁর প্রতি রইল শ্রদ্ধার্ঘ্য।