শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

ছেলেবেলায় কাগজ বিলি থেকে পরবর্তীতে 'মিসাইল ম্যান অফ ইন্ডিয়া'! প্রয়াণ দিবসে স্মরণে এপিজে আবদুল কালাম

১২:০৬ পিএম, জুলাই ২৭, ২০২১

ছেলেবেলায় কাগজ বিলি থেকে পরবর্তীতে 'মিসাইল ম্যান অফ ইন্ডিয়া'! প্রয়াণ দিবসে স্মরণে এপিজে আবদুল কালাম

তাঁকে বলা হতো 'মিসাইল ম্যান অফ ইন্ডিয়া'! ‘জনগণের রাষ্ট্রপতি’ বা ‘পিপলস প্রেসিডেন্ট’ হিসেবেও প্রবল জনপ্রিয়তা লাভ করেছিলেন তিনি। ছেলেবেলায় আর্থিক অনটন মেটাতে কাগজও বিলি করতে হয়েছিল তাঁকে। সেই তিনিই পরবর্তীতে হয়ে উঠলেন দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাষ্ট্রপতি। শুধু তাই নয়, অসামান্য বিজ্ঞানীও ছিলেন তিনি। তাঁর হাত ধরে বৈজ্ঞানিক ক্ষেত্রে অবাধ বিচরণ ছিল ভারতের৷ তিনি, ডঃ এপিজে আব্দুল কালাম। আজ তাঁর প্রয়াণবার্ষিকীতে রইল শ্রদ্ধার্ঘ্য...

১৯৩১ সালের ১৫ অক্টোবর, বৃহস্পতিবার, ব্রিটিশ ভারতের মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির (অধুনা ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্যের) রামেশ্বরমের এক তামিল মুসলমান পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন আবদুল কালাম। বাবা জয়নুল-আবেদিন ছিলেন একজন নৌকামালিক এবং মাতা অশিয়াম্মা গৃহবধূ। কালামের বাবা কাঠের নৌকা তৈরি করতেন। সেই নৌকা তিনি ভাড়া দিতেন মৎসজীবীদের। এছাড়াও তীর্থযাত্রীদের নৌকা পারাপারও করাতেন৷ কালামরা পাঁঁচ ভাই ও পাঁচ বোন ছিলেন। কালামের পরিবার ছিল অত্যন্ত গরিব। আর্থিক অনটনে দিন কাটত তাঁদের। তাই নিজের পড়াশোনার খরচ যোগাতে একসময় খবরের কাগজও বিলি করতে হতো তাঁকে।

প্রবল জেদ ও ইচ্ছাশক্তিতে ভর করেই জীবনে সফল হয়েছিলেন কালাম। রামেশ্বরমের ছোট্ট পরিবার থেকে রাইসিনা হিল পর্যন্ত তাঁর যাত্রাপথ কিন্তু এত সহজ ছিল না। স্থানীয় হায়ার সেকেন্ডারি স্কুল থেকে পাশ করে তিরুচুরাপল্লির সেন্ট জোসেফ কলেজে ভর্তি হন কালাম। ১৯৫৪ সালে পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে এই কলেজ থেকেই পাশ করে বেরোন তিনি। ১৯৫৫ সালে মাদ্রাজ ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে অ্যারোস্পেস টেকনোলজি পড়তে তিনি মাদ্রাজ চলে যান। তাঁর স্বপ্ন ছিল তিনি ফাইটার পাইলট হবেন। কিন্তু সে স্বপ্নটিও সামান্য একটুর জন্য অধরা থেকে যায়। ইন্ডিয়ান এয়ারফোর্সের (আইএএফ) আটটি পজিশনের জন্য পরীক্ষায় কৃতকার্য ব্যক্তিদের মধ্যে প্রথম আটজনকে নেওয়া হয়েছিল। কালামের পজিশন ছিল ঠিক তারপর নয় নম্বরে। ফলে পাইলট হওয়ার সুযোগ হারান তিনি।

১৯৬০ সালে পাশ করে বেরোবার পর ডিফেন্স রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট সংস্থার অ্যারোনটিক্যাল ডেভেলপমেন্ট প্রতিষ্ঠানে একজন বিজ্ঞানী হিসেবে যোগ দেন কালাম। ১৯৬৯ সালে তিনি ইন্ডিয়ান স্পেস রিসার্চ অর্গানাইজেশনে (আইএসআরও), ভারতের প্রথম স্যাটেলাইট লঞ্চ ভেহিক্যাল (এসএলভি-৩)-এর প্রজেক্ট ডিরেক্টর হিসেবে স্থানান্তরিত হন। সেখান থেকে ভারতের প্রথম স্যাটেলাইট ‘রোহিণী” সফলভাবে উৎক্ষেপণ করা হয়। ১৯৭০ সালে তিনি ‘প্রজেক্ট ডেভিল’ ও ‘প্রজেক্ট ভেলিয়ান্ট’ নামে মিসাইল উদ্ভাবনের এই প্রজেক্ট দুটি পরিচালনা করেন। এতে অর্থলগ্নি করতে ইউনিয়ন ক্যাবিনেট রাজি না থাকায় গোপনে টাকা ঢালেন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী।

এই মিসাইল প্রোগ্রাম সফল হওয়ায় ১৯৮০ সালের মধ্যে আবদুল কালাম অনেক খ্যাতি ও পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৮০ সালে ভারত সরকার তাঁকে ‘অ্যাডভান্সড মিসাইল প্রোগ্রাম প্রজেক্ট’-এর পরিচালকের দায়িত্ব দেন। এ সময় তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আর ভেঙ্কটরমন ক্যাবিনেট থেকে ৩ দশমিক ৮৮ বিলিয়ন টাকা অনুমোদন করিয়ে আনেন এবং নাম দেন ইন্টিগ্রেটেড গাইডেড মিসাইল ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম (আইজিএমডিপি)। কালামকে প্রতিষ্ঠানটির চিফ এক্সিকিউটিভ নিযুক্ত করেন তিনিই। এরপর কালাম এই প্রজেক্টের মাধ্যমে বহু মিসাইল বানান, যার মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য, ব্যালিস্টিক মিসাইল ‘অগ্নি’ ও সারফেস টু সারফেস মিসাইল ‘পৃথিবী’। এছাড়াও ভারতের প্রভূত মিসাইল তৈরির পিছনে হাত ছিল কালামের৷ তাঁর নাম দেওয়া হয়েছিল 'মিসাইল ম্যান অফ ইন্ডিয়া'।

প্রেসিডেন্ট কে আর নারায়ণনের পর ২০০২ সালের ২৫ জুলাই পাঁচ বছরের মেয়াদে ভারতের ১১তম রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন কালাম। মহাকাশ বিজ্ঞানী ‘মিসাইল ম্যান' ডঃ আবদুল কালাম ২০০২ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত ভারতের রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন। ‘জনগণের রাষ্ট্রপতি' হিসেবেই সারা ভারতের সব শ্রেণির মানুষের কাছে পরিচিত এই মানুষটি। নিজেকে সবার আগে একজন শিক্ষক হিসাবেই মানুষের কাছে পরিচয় দিতেন তিনি এবং তারপরে আসত তাঁর যাবতীয় অন্য দায়িত্ব। আবদুল কালাম ভারতের তৃতীয় রাষ্ট্রপতি, যিনি প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগেই দেশের সর্বোচ্চ সম্মাননা, ‘ভারতরত্ন’ উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন। অবসরের পর দেশের বিভিন্ন বিখ্যাত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যাপনার কাজ করতেন আবদুল কালাম।

২০১৫ সালের ২৭ জুলাই শিলংয়ের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্টে ভাষণ দিতে ওঠার সময় অস্বস্তি বোধ করেন কালাম। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেওয়ার পর বক্তৃতা শুরু করেন তিনি। কিন্তু মাত্র পাঁচ মিনিটের মাথাতেই জ্ঞান হারান। তাঁকে কাছাকাছি বেথানি হাসপাতালে নেওয়া হলে সন্ধ্যা ৭টা ৪৫ মিনিটে হৃদ্‌যন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে তাঁর মৃত্যু হয়। ২৮ জুলাই হাসপাতাল থেকে কালামকে দিল্লি এবং ২৯ জুলাই তাঁকে নিজের বাসভূমি রামেশ্বরমে আনা হয়। ৩০ জুলাই ‘পেই কারেম্বুর’ মাঠে পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাধিস্থ করা হয় ডঃ এপিজে আবদুল কালামকে।