বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪

বাঙালির রোজনামচার সঙ্গে জড়িয়ে চড়ক-গাজনের নাম! রয়েছে কোন কোন রীতি-নিয়ম?

০৭:৫১ পিএম, এপ্রিল ১৩, ২০২১

বাঙালির রোজনামচার সঙ্গে জড়িয়ে চড়ক-গাজনের নাম! রয়েছে কোন কোন রীতি-নিয়ম?

‘ধান ভানতে শিবের গাজন’ বা ‘চক্ষু চড়কগাছ’! বাঙালির রোজনামচার সঙ্গে ওতোপ্রোতোভাবে জড়িয়ে রয়েছে এই দুটি প্রবাদ। বাংলার প্রায় সমস্ত মানুষের রোজকার কথাবার্তায় এই প্রবাদ দুটির উল্লেখ পাওয়া যায়। কোনও বিষয়ের বর্ণনা দিতে গিয়ে কেউ বেশি কথা বললে ‘ধান ভানতে শিবের গাজন’ অথবা অবাক হয়ে গেলে ‘চক্ষু চড়কগাছ’, প্রবাদ দুটি যেন বাঙালির মুখে মুখে ফেরে। কিন্তু কী এই গাজন বা চড়কগাছ?

এটি আদতে গ্রাম বাংলার প্রাচীন লোক-সংস্কৃতির নির্দশন। চৈত্রের শেষ দিনগুলো ধরে পল্লীগ্রামে চলে গাজন উৎসব ও চড়ক পুজো। গাজনের শেষ দিন অর্থাৎ চৈত্র সংক্রান্তির দিন বিভিন্ন গ্রাম-গঞ্জে পালিত হয় চড়ক। পশ্চিমবঙ্গের নানান প্রান্তে বিভিন্ন নামে ও বিভিন্ন ভাবে গাজন পালন করা হয়। বিশেষ করে পূর্ব বর্ধমান জেলার কাটোয়া মহকুমা ও মুর্শিদাবাদ জেলার কান্দি মহকুমায় বেশ ধুমধামের সঙ্গে হয় গাজন। এছাড়া দক্ষিণ চব্বিশ পরগনাতেও হয় গাজনের উৎসব।

[caption id="attachment_10382" align="alignnone" width="1200"]বাঙালির রোজনামচার সঙ্গে জড়িয়ে চড়ক-গাজনের নাম! রয়েছে কোন কোন রীতি-নিয়ম? / Image Credit: Suvankar Sen বাঙালির রোজনামচার সঙ্গে জড়িয়ে চড়ক-গাজনের নাম! রয়েছে কোন কোন রীতি-নিয়ম? / Image Credit: Suvankar Sen[/caption]

গাজন উৎসবের দিনগুলি-

মঠ সন্ন্যাসঃ গাজনের প্রথম দিন একজন মুখ্য সন্ন্যাসী সকলকে সন্ন্যাস দেন। একে আঞ্চলিক ভাষায় ‘উত্তুরী নেওয়া’ও বলা হয়ে থাকে। এর পরদিন হয় মঠ সন্ন্যাস। এদিন ভক্তরা মানত করে বাবার পুকুরে স্নান সেরে মন্দিরের চারিদিকে গন্ডি কাটেন ও বাবার মাথায় জল ঢালেন।

হাট সন্ন্যাসঃ মঠ সন্ন্যাসের পরদিন ‘হাট সন্ন্যাস’ বা ‘ঝাঁপ’। শিবমন্দির থেকে বেশ খানিকটা উঁচুতে বাঁশের মাচা বাঁধা হয়। একে বলা হয় ‘হাঙা’। এই হাঙার উপর থেকে সন্ন্যাসীরা নীচে সাজানো সিঁদুর মাখানো লোহার অস্ত্রের ওপর ঝাঁপ দেন। এর মাধ্যমে সন্ন্যাসী বা ভক্তরা নিজেদের শরীরকে নানাভাবে যন্ত্রণা দিয়ে কৃচ্ছ্র সাধনের মাধ্যমে দেবতাকে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করেন।

নীল ষষ্ঠীঃ এরপর দিন আসে নীলপুজো অর্থাৎ নীল ষষ্ঠী। লৌকিক বিশ্বাস, চৈত্র মাসে দেবী চন্ডীকার সঙ্গে শিবের বিবাহ হয়েছিল। এই বিবাহ উৎসব উপলক্ষ্যেই নীল উৎসবের সূচনা। এদিন বাড়ির মায়েরা সন্তানের মঙ্গল কামনায় উপোস রাখেন। শিবের মাথায় জল ঢালেন এবং পুজো দেন।

চড়ক উৎসবঃ গাজনের শেষদিন হয় চড়ক যাত্রা। এদিন বেল কাঠ দিয়ে তৈরি চড়ক কাঠ পুকুর থেকে তোলা হয়। সেই চড়ক কাঠ মাটিতে পুঁথে মাথায় আলের সঙ্গে কাঠ গেঁথে দেওয়া হয়। এরপর কাঠের দুই দিকে সন্ন্যাসীদের গামছায় বেঁধে বা পিঠের চামড়ায় বঁড়শির মতো গেঁথে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। তারপর সন্ন্যাসীদের ঝুলন্ত অবস্থায় সেই চড়ক গাছটিকে ঘোরানো হয়। একেই বলা হয় চড়ক গাছ।

[caption id="attachment_10383" align="alignnone" width="1024"]বাঙালির রোজনামচার সঙ্গে জড়িয়ে চড়ক-গাজনের নাম! রয়েছে কোন কোন রীতি-নিয়ম? / Image Credit: Suvankar Sen বাঙালির রোজনামচার সঙ্গে জড়িয়ে চড়ক-গাজনের নাম! রয়েছে কোন কোন রীতি-নিয়ম? / Image Credit: Suvankar Sen[/caption]

যদিও ১৮৬৫ সালে লর্ড বিডন সাহেব চড়কে বাণফোঁড়া অর্থাৎ পিঠে বঁড়শি গাঁথার এই প্রথা নিষিদ্ধ করে দেন। বর্তমানে কালের অমোঘ নিয়মে হারিয়ে গিয়েছে গাজনের আরও টুকরো টাকরা নানা প্রথা। গাজনেরও বিবর্তন ঘটে চলেছে। তবে কাটোয়া-বর্ধমান জেলার বেশ কিছু গ্রামে এখনও ধূমধামের সঙ্গেই পালিত হয় চড়ক এবং গাজন। গত করোনার দাপটে চড়ক উৎসব বন্ধ হয়ে গেলেও, চলতি বছরে বেশ কিছু জায়গায় ধুমধামের সঙ্গেই হচ্ছে চড়ক উৎসব। বসেছে গাজনের মেলাও। উৎসাহী মানুষের ভীড়ে এই কদিন রীতিমতো জমে উঠেছে গ্রাম বাংলার প্রাচীন এই উৎসব।