শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪

সাহিত্যচর্চার জন্য ছেড়েছিলেন ওকালতি! কেমন ছিল ব্যোমকেশ স্রষ্টা শরদিন্দুর এই যাত্রাপথ?

০৩:৪৪ পিএম, সেপ্টেম্বর ২২, ২০২১

সাহিত্যচর্চার জন্য ছেড়েছিলেন ওকালতি! কেমন ছিল ব্যোমকেশ স্রষ্টা শরদিন্দুর এই যাত্রাপথ?

বাংলা সাহিত্যের এক অতি পরিচিত নাম সাহিত্যিক শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়। আর সাহিত্যিকের এই নামের সঙ্গেই যেন ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ব্যোমকেশ বক্সীর নামও। শরদিন্দু মানেই ব্যোমকেশ! তবে পেশার উকিল ব্যোমকেশ স্রষ্টার সাহিত্য জীবনে প্রবেশ ঘটল কীভাবে? ওকালতি ছেড়ে কীভাবে তিনি সাহিত্য চর্চাকেই বানিয়েছিলেন জীবনের রসদ? কেমন ছিল তাঁর যাত্রাপথ? সাহিত্যিকের প্রয়াণ দিবসে রইল সেই কাহিনীই...

১৮৯৯ সালের ৩০ মার্চ উত্তরপ্রদেশের জৌনপুর শহরে জন্মগ্রহণ করেন শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁদের আদি নিবাস ছিল কলকাতার উত্তরে বরানগরে। বাবা তারাভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় বিহারের পূর্ণিয়ায় ওকালতি করতেন। সেখান থেকে তিনি মুঙ্গেরে চলে যান। সেই সুবাদে শরদিন্দুর স্কুলশিক্ষা মুঙ্গেরে। ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করার পর শরদিন্দু কলকাতার বিদ্যাসাগর কলেজে ভর্তি হন। পড়াশোনার সঙ্গে চলতে থাকে সাহিত্যচর্চাও। ছোট ছোট কবিতা ও গল্প লিখতে থাকেন শরদিন্দু। তাঁর রচিত প্রথম সাহিত্য প্রকাশিত হয় তার ২০ বছর বয়সে, যখন তিনি কলকাতায় বিদ্যাসাগর কলেজে পড়ছিলেন। তা ছিল ‘যৌবন-স্মৃতি’ নামক বাইশটি কবিতার একটি সংকলন। এরপর ১৯২৬ সালে আইন পাশ করার পর বাবার জুনিয়র হিসাবে শরদিন্দু ওকালতি শুরু করেন।

ওকালতি জীবনে বসুমতীতে ছাপা হল শরদিন্দুর প্রথম গল্প উড়ো মেঘ। ধীরে ধীরে প্রবাসী, ভারতবর্ষ তাঁর লেখা নিতে থাকল। এরপর শরদিন্দু বুঝতে পারলেন সাহিত্যই তার সাধনা। ওকালতি করলেও মন সেই পড়ে থাকত সাহিত্যচর্চাতেই। শেষ পর্যন্ত ১৯২৯-এ ওকালতি ছেড়ে সাহিত্যকেই জীবিকা হিসাবে গ্রহণ করেন শরদিন্দু। এরপর সাল ১৯৩২। শরদিন্দুর লেখনীতে আত্মপ্রকাশ ঘটে 'সত্যান্বেষী' ব্যোমকেশ বক্সীর। রচনাকাল অনুসারে ব্যোমকেশ সিরিজের প্রথম গল্প ‘পথের কাঁটা’। তার পর ‘সীমান্তহীরা’। শরদিন্দুর নিজের কথায়, “এই দু’টি গল্প লেখার পর ব্যোমকেশকে নিয়ে একটি সিরিজ লেখার কথা মনে হয়। তখন ‘সত্যান্বেষী’ গল্পে (২৪ মাঘ ১৩৩৯ বঙ্গাব্দ) ব্যোমকেশ চরিত্রটিকে এসট্যাবলিস করি। পাঠকদের সুবিধার জন্য অবশ্য ‘সত্যান্বেষী’কেই ব্যোমকেশের প্রথম গল্প বলে ধরা হয়।"

[caption id="attachment_32878" align="alignnone" width="1280"]সাহিত্যচর্চার জন্য ছেড়েছিলেন ওকালতি! কেমন ছিল ব্যোমকেশ স্রষ্টা শরদিন্দুর এই যাত্রাপথ? সাহিত্যচর্চার জন্য ছেড়েছিলেন ওকালতি! কেমন ছিল ব্যোমকেশ স্রষ্টা শরদিন্দুর এই যাত্রাপথ?[/caption]

তবে চার বছরে ব্যোমকেশকে নিয়ে ১০টি গল্প লেখার পর শরদিন্দু আর ব্যোমকেশের কথা ভাবেননি। তারপর কেটে যায় ১৫ বছর। সে সময় একবার তিনি বম্বে থেকে কলকাতা আসেন। সেখানেই তাঁর পরিচিত এক বাড়ির ছেলেমেয়েরা অভিযোগ করেন, কেন তিনি ব্যোমকেশকে নিয়ে আর লিখছেন না। শরদিন্দুর তখন মনে হয়, ছেলেমেয়েরা তাহলে ব্যোমকেশ পড়তে চায়। দীর্ঘ বিরতির পর এবার ‘চিত্রচোর’ (১৩৫৮ বঙ্গাব্দ) কাহিনীর মাধ্যমে ফের ব্যোমকেশের আত্মপ্রকাশ ঘটান তিনি। সেই থেকে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ব্যোমকেশ ছিল তাঁর সঙ্গী। গল্প-উপন্যাস মিলিয়ে মোট ৩২টি ব্যোমকেশ কাহিনী লিখেছেন শরদিন্দু।

ব্যোমকেশ ছাড়াও ঐতিহাসিক উপন্যাস রচনাতেও বিপুল খ্যাতি অর্জন করেছিলেন শরদিন্দু। 'কালের মন্দিরা', 'গৌড়মল্লার', 'তুমি সন্ধ্যার মেঘ', 'তুঙ্গভদ্রার তীরে', ‘কুমারসম্ভবের কবি’ ইত্যাদি উপন্যাসের মাধ্যমে পাঠকদের মন ছুঁয়েছিলেন তিনি। 'তুঙ্গভদ্রার তীরে'র জন্য পেয়েছেন রবীন্দ্র পুরস্কারও। শরদিন্দুর নিজের কথায়, “ইতিহাসের গল্প লিখেই বেশি তৃপ্তি পেয়েছি। মনে কেমন একটা সেন্স অফ ফুলফিলমেন্ট হয়। গৌড়মল্লার ও তুঙ্গভদ্রার তীরে লেখার পর খুব তৃপ্তি পেয়েছিলাম।” এছাড়াও তাঁর লেখা সামাজিক উপন্যাস যেমন 'বিষের ধোঁয়া' বা অতিপ্রাকৃত নিয়ে তাঁর 'বরদা সিরিজ' ও অন্যান্য গল্প এখনও জনপ্রিয়। সদাশিবের কাণ্ড-কারখানা নিয়ে লেখা শরদিন্দুর কিশোর-কাহিনিগুলোও আজ সমান সমাদৃত।

সাহিত্যিক হিসেবে পথচলার পাশাপাশি চিত্রনাট্যকার হিসেবেও সুনাম কুড়িয়েছিলেন শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়। ১৯৩৮ সালে মুম্বইয়ের বম্বে টকিজে চিত্রনাট্যকার রূপে কাজ শুরু করেন তিনি। তবে ১৯৫২ সালে সিনেমার কাজ ছেড়ে স্থায়ী ভাবে পুনেতে বসবাস করতে শুরু করেন। পরবর্তী ১৮ বছর তিনি সাহিত্যচর্চাতেই অতিবাহিত করেন। সাহিত্যিক-চিত্রনাট্যকারের পাশাপাশি অভিনয়ও করেছেন শরদিন্দু। ১৯৩৬ সালে রবীন্দ্রজয়ন্তীতে রেডিওয় লেখকদের নিয়ে 'বৈকুন্ঠের খাতা'-য় কেদারের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন তিনি। এছাড়াও বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের সঙ্গেও অভিনয় করেছিলেন। এরপর জীবনের শেষ ক'টা বছর সাহিত্যেই ডুবে থাকার পর ১৯৭০ সালের ২২ সেপ্টেম্বর, আজকের দিনেই মৃত্যু হয় শরদিন্দুর। আজ, মহান এই সাহিত্যিকের প্রয়াণ দিবসে রইল শ্রদ্ধার্ঘ্য...