রবিবার, ১৯ মে, ২০২৪

জানেন কেন মহালয়াতেই করা হয় পিতৃতর্পণ? মহালয়ার অর্থই বা কী?

মৌসুমী মোদক

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১৪, ২০২২, ০৩:০৫ পিএম | আপডেট: সেপ্টেম্বর ১৪, ২০২২, ০৯:০৫ পিএম

জানেন কেন মহালয়াতেই করা হয় পিতৃতর্পণ? মহালয়ার অর্থই বা কী?
জানেন কেন মহালয়াতেই করা হয় পিতৃতর্পণ? মহালয়ার অর্থই বা কী? / প্রতীকী ছবি

আর মাত্র কয়েকটা দিনের অপেক্ষা। তারপরই আশ্বিনের শারদ প্রাতে বেজে উঠবে আলোর বেণু। অর্থাৎ মহালয়া। মহালয়ার দিনে পিতৃপক্ষের অবসান ঘটিয়ে সূচনা হয় মাতৃপক্ষের। এই দিনের অন্যতম তাৎপর্যপূর্ণ হল তর্পণ। এই দিন পিতৃপুরুষদের উদ্দেশ্যে তর্পণ করার রীতি রয়েছে। দক্ষিণ ও পশ্চিম ভারতে গণেশ উৎসবের পরবর্তী পূর্ণিমা (ভাদ্রপূর্ণিমা) তিথিতে এই পক্ষ সূচিত হয় এবং সমাপ্ত হয় সর্বপিতৃ অমাবস্যা, মহালয়া অমাবস্যা বা মহালয়া দিবসে। উত্তর ভারত ও নেপালে ভাদ্রের পরিবর্তে আশ্বিন মাসের কৃষ্ণপক্ষকে পিতৃপক্ষ বলা হয়।

মহালয়া শব্দটির অর্থ, মহান আলয় বা আশ্রম। আর দেবী দুর্গাই হলেন সেই মহান আলয়। পুরাণ মতে, কথিত রয়েছে, মহালয়ার দিন অসুর ও দেবতাদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছিল। পুরাণ মতে, ব্রহ্মার বরে মহিষাসুর ছিলেন অমর। কেবল কোনও নারীশক্তির কাছে পরাজয় নিশ্চিত ছিল৷ অসুরদের অত্যাচারে যখন দেবতারা যখন কূল পাচ্ছেন না, সে সময় ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর নারীশক্তির সৃষ্টি করেন। তিনিই মহামায়ারূপী দেবী দুর্গা। তাঁর দশ হাতে উঠল দেবতাদের দেওয়া অস্ত্র। তা দিয়েই মহিষাসুরকে বধ করেন দেবী। এই দিনটিকেই মহালয়া হিসেবে গণ্য করা হয়।

মহালয়ার দিনটিতে যেহেতু পিতৃ পুরুষদের উদ্দেশ্যে তর্পণ করার রীতি রয়েছে তাই এদিন পিতৃপুরুষদের স্মরণ করা হয়। কথিত রয়েছে, যমরাজ ১৬ দিনের জন্য দেবরাজ ইন্দ্রকে মর্তে পাঠিয়েছিলেন। এই ১৬ দিনই তাঁকে মর্তে তর্পণ করতে বলা হয়। এখান থেকেই শুরু হয় মহালয়ার দিন এবং তার আগের ১৫ দিন পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে তর্পণ করা হয়। হিন্দুশাস্ত্রে নানারকম তর্পণের কথা বলা হয়েছে, যেমন, দেব তর্পণ, গুরু তর্পণ, মনুষ্য তর্পণ, ঋষি তর্পণ, দিব্যপিতৃ তর্পণ, যম তর্পণ, ভীষ্ম তর্পণ, পিতৃ তর্পণ, মাতৃ তর্পণ, অগ্নিদগ্ধাদি তর্পণ, রাম তর্পণ ও লক্ষণ তর্পণ।  পিতৃপক্ষের শেষ লগ্নে তর্পণ করা হয় এই মন্ত্রের সঙ্গে- "পিতা স্বর্গঃ পিতা ধর্ম্মঃ পিতা হি পরমন্তপঃ। পিতরি প্রীতিমাপন্নে প্রীয়তে সর্ব্ব দেবতাঃ।"

শাস্ত্রবিশেষজ্ঞদের মতে, পিতৃপক্ষের অবসানে, অমাবস্যার অন্ধকার পেরিয়ে আমরা আলোকজ্জ্বল দেবীপক্ষকে আগমন করি, তাই সেই মহা লগ্ন আমাদের জীবনে ‘মহালয়া’। শোক, তাপ, দুঃখ, অমঙ্গল, অন্ধকার কাটিয়ে আলোকে উত্তরণের পথে এক ধাপ এগিয়ে চলার ক্ষণই সেই মহালয়া। তর্পণের শেষে তাই সূর্যপ্রণাম করে অসুরবিনাশিনী দেবীকে আহ্বান করে বলা হয়- "সর্ব মঙ্গল মঙ্গল্যে শিবে সর্বার্থ সাধিকে/ শরণ্যে ত্রম্বকে গৌরি নারায়নী নমস্তুতে।"

তর্পণ যে কেবল পূর্বপুরুষদের জন্য তা নয়, পৃথিবীর সামগ্রিক সুখ, স্বাচ্ছন্দ্যে, উত্তোরণের উদ্দেশে। সেই কারণেই তর্পণ মন্ত্রে বলা হয়ে থাকে, "তৃপ্যন্তু সর্বমানবা"। অর্থাৎ মানবজাতিকে তৃপ্ত করার দিন। এই তর্পণ শব্দের ব্যুৎপত্তি হল তৃপ + অনট। তৃপ ধাতুর অর্থ তৃপ্তি সাধন করা। এখানে তৃপ্তি সাধন বলতে দেব-ঋষি- পিতৃ-মনুষ্যগণের তৃপ্তিসাধনকে করার অর্থে ব্যবহার করা হয়। হিন্দুধর্মে দেবতা, ঋষি ও মৃত পূর্বপুরুষদের (পিতৃকুল ও মাতৃকুল) উদ্দেশ্যে জল নিবেদন করে তাঁদের সন্তুষ্ট করার পদ্ধতিকে তর্পণ বলা হয়। বংশের যে সকল‌ পিতৃপুরুষ পরলোক গমন করেছেন, তাঁদের প্রীতির উদ্দেশ্যে মন্ত্র উচ্চারণপূর্বক স-তিল জল (তিল মেশানো জল) দান করে সাধারণত পুত্রসন্তানেরা পিতৃতর্পণ করে থাকেন। এভাবে তর্পণ করাকে আবার তিল তর্পণও বলে।

মহালয়ের এই লগ্নে যাঁদের পুত্র নেই, যাঁদের কেউ নেই, তাঁদেরও স্মরণ করা হয়ে থাকে তর্পণের মাধ্যমে। তাই মন্ত্রে উল্লেখ করা হয়ে থাকে, ওঁ নমঃ যে বান্ধবা অবান্ধবা বা, যে অন্য জন্মনি বান্ধবাঃ। তে তৃপ্তিং অখিলাং যান্ত, যে চ অস্মৎ তোয়-কাঙ্খিণঃ। অর্থাৎ, যাঁরা আমাদের বন্ধু ছিলেন, যাঁরা বন্ধু নন, যাঁরা জন্ম-জন্মান্তরে আমাদের বন্ধু ছিলেন, যাঁরা আমাদের কাছে জলের প্রতাশা করেন, তাঁরা সম্পূর্ণরূপে তৃপ্তিলাভ করুন।