শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪

‘আমি বড়ই স্বার্থপর, এটাই শেষ পোস্ট!’ ঐন্দ্রিলাকে নিয়ে কী বলেছিলেন সব্যসাচী?

আত্রেয়ী সেন

প্রকাশিত: নভেম্বর ২১, ২০২২, ১১:৩১ এএম | আপডেট: নভেম্বর ২১, ২০২২, ০৫:৫৪ পিএম

‘আমি বড়ই স্বার্থপর, এটাই শেষ পোস্ট!’ ঐন্দ্রিলাকে নিয়ে কী বলেছিলেন সব্যসাচী?
‘আমি বড়ই স্বার্থপর, এটাই শেষ পোস্ট!’ ঐন্দ্রিলাকে নিয়ে কী বলেছিলেন সব্যসাচী?

বংনিউজ২৪x৭ ডিজিটাল ডেস্কঃ গতকালই লড়াই শেষ হয়েছে! মৃত্যুর কাছে হার মেনে নিয়েছেন ‘লড়াকু’ ঐন্দ্রিলা শর্মা। মাত্র ২৪ বছর বয়সে প্রয়াত ‘জিয়ন কাঠি’ খ্যাত অভিনেত্রী ঐন্দ্রিলা শর্মা। পিছনে রেখে গিয়েছে তাঁর অসংখ্য অনুরাগী, পরিবার-পরিজন, বন্ধু, সহকর্মী, এবং অবশ্যই কাছের মানুষ সব্যসাচীকে। কঠিন সময়ে ঐন্দ্রিলার পাশে সবসময় ছিলেন সব্যসাচী। ঐন্দ্রিলা এবং সব্যসাচীর সম্পর্ক সকলের কাছেই উদাহরণস্বরূপ। বন্ধুত্ব, ভালোবাসার পাঠ শিখিয়েছে বারবার তাঁদের সম্পর্ক। তাঁদের সেই সম্পর্কের কাছে মৃত্যুও হার মেনেছে বারে-বারে। সব্যসাচী চৌধুরী ও ঐন্দ্রিলা শর্মার সম্পর্ক এমনই সুরে সাজানো। তবে, রবিবার সেই রূপকথা যেন তাসের দেশের মতো ভেঙে পড়ল। সকলের সমস্ত চেষ্টা, প্রার্থনা ব্যর্থ করে চিরঘুমের দেশে পাড়ি দিলেন অভিনেত্রী ঐন্দ্রিলা শর্মা।

‘আমি বড়ই স্বার্থপর’। ঐন্দ্রিলা শর্মাকে নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় আপডেট দিতে গিয়ে একবার এমনটাই বলেছিলেন ঐন্দ্রিলার ‘কাছের মানুষ’ সব্যসাচী। তিনি বলেছিলেন, ঐন্দ্রিলাকে নিয়ে আর পোস্ট করবেন না। কারণ সেইদিন ঐন্দ্রিলা দ্বিতীয়বারের জন্য ক্যানসারকে হারিয়ে জীবনযুদ্ধে জয়ী হয়েছিলেন। ফিরে এসেছিলেন প্রিয় মানুষ সব্যসাচীর কাছে।

কিন্তু এবার আর ফের হল না। এবার আর ফিনিক্স হতে পারলেন না বছর ২৪-এর প্রাণবন্ত, সদাহাস্য মেয়েটা। প্রিয় মানুষটাকে সারা জীবনের মতো একলা করে দিয়ে চলে গেলেন তিনি। এবার আর সত্যিই ঐন্দ্রিলাকে নিয়ে পোস্ট করার মতো কিছুই থাকল না তাঁর কাছে। আগেই ঐন্দ্রিলার সব হেলথ আপডেট ডিলিট করে দিয়েছিলেন তিনি। আর এবার গোটা ফেসবুকটাই উড়িয়ে দিলেন অভিনেতা।

কিন্তু কেন নিজেকে স্বার্থপর বলেছিলেন সব্যসাচী? দ্বিতীয়বার ঐন্দ্রিলার শরীরে মারণ ক্যানসার থাবা বসানোর পর থেকে দীর্ঘ চিকিৎসার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছিল তাঁকে। ঐন্দ্রিলার সেই লড়াইয়ের কথা নিয়মিত নিজের ফেসবুক ওয়ালে পোস্ট করতেন সব্যসাচী। তাঁকে নিয়ে দিনরাত উদ্বেগে থাকতেন অভিনেতা। তাও জীবনীশক্তি বিন্দুমাত্র কম ছিল না তাঁদের। সব্যসাচীর দেওয়া ঐন্দ্রিলার শারীরিক অবস্থার খবর জানতেও অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতেন তাঁর ভক্তরা। ঐন্দ্রিলার ভক্ত এবং শুভাকাঙ্খিদের খুশি করে ডিসেম্বরে শেষবার একটা সুদীর্ঘ পোস্ট করেছিলেন ঐন্দ্রিলার সব্য। জানিয়েছিলেন, এটাই তাঁর শেষ পোস্ট। কারণ সেটাই ছিল ঐন্দ্রিলার চিকিৎসার শেষ মাস। সব্যসাচী লিখেছিলেন, ‘একটা মেয়ে অনন্ত নিশি থেকে ধূমকেতুর মতন ছুটে এসে ফের নিকষ অন্ধকারে হারিয়ে যাবে, সেটা আমিও ঠিক মেনে নিতে পারিনি। আজ আমি অকপটে স্বীকার করতেই পারি যে আমি বড়ই স্বার্থপর। তোমাদের আপডেট দেওয়ার একটাই উদ্দেশ্য ছিল আমার। আমি চেয়েছিলাম তোমাদের মনে ওকে বাঁচিয়ে রাখতে, ওকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখাতে যে তোমায় কেউ ভোলেনি, কয়েক হাজার মানুষ স্বার্থহীনভাবে অপেক্ষা করছে, ভালোবাসছে, প্রার্থনা করছে তোমার জন্য। তাই লজ্জার মাথা খেয়ে আমি প্রতি মাসেই কলম ধরেছি।’

এক পুরনো চলচ্চিত্রের দৃশ্য তুলে ধরেছিলেন সব্যসাচী। তাঁর কথায়, ‘বেশ কয়েক বছর আগে, ইংমার বার্গম্যানের একটা বহু পুরোনো সিনেমা দেখেছিলাম, যেখানে মৃত্যু এসেছে নায়কের প্রাণ নিতে আর এক ধূসর প্রান্তরে বসে, নায়ক মৃত্যুর সাথে দাবা খেলছে। খুব সামনে থেকে এই অসুখটাকে পর্যবেক্ষণ করে, বারবার ওই সিনেমাটার কথা মনে পড়ে যায় আমার।’

গত ডিসেম্বরে ক্যানসারের প্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচারের ঠিক ছয় মাস পূর্ণ হয়। চিকিৎসকরা পরীক্ষা করে জানিয়েছিলেন, ঐন্দ্রিলার শরীরে আর কোনও ক্যানসারের কোষ অবশিষ্ট নেই। তখন, সব্যসাচী দরাজ কণ্ঠে জানিয়েছিলেন, ‘এই মুহূর্তে ঐন্দ্রিলা সুস্থ এবং বিপন্মুক্ত।’ জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ঐন্দ্রিলা তাঁর অদম্য ইচ্ছেশক্তিকে ধরে রেখেছিলেন। যার জোরে এর আগে দুবার তিনি ফিরে এসেছিলেন সবার মাঝে মারণ ক্যানসারকে হারিয়ে। কিন্তু এবার আর পারলেন না।

ঐন্দ্রিলা শর্মা আর তাঁর সঙ্গেই ছায়াসঙ্গীর মতো লড়ছিলেন সব্যসাচী চৌধুরীও প্রত্যেক কঠিন মুহূর্তে। তাই তো রবিবার কেওড়াতলা মহাশ্মশানে ঐন্দ্রিলার নিথর, প্রাণহীন দেহটার পাশে বসে থাকা সব্যসাচীকে দেখা গেল বিমর্ষ-নিস্তেজ। প্রিয় মানুষটাকে ফেরাতে না পেরে, লড়াইয়ে যেন হেরে গিয়েছেন সব্যসাচীও। সব্যসাচী যেন যন্ত্রের মতো হয়ে গিয়েছেন। কোনও কথা নেই। সবই করছিলেন যন্ত্রের মতো। একেবারে চুপ, যেন সর্বহারা। যেন কিছুই আর ফিরে পাওয়ার নেই। যন্ত্রের মতো, নীরব বসে। ঐন্দ্রিলার সঙ্গে লড়াই করেছেন তিনিও। চোখের জলও বোধহয় শুকিয়ে গেছে তাঁর। এদিন হাসপাতালে ঐন্দ্রিলার নিস্তেজ দেহের দিকে তাকিয়ে বসেছিলেন তিনি। আবার শববাহী শকটের সামনের সিটেও ছিলেন তিনি। কাছের মানুষ, বন্ধুর শেষ যাত্রাতেও তাঁর ছায়াসঙ্গি হয়ে ছিলেন ভালোবাসার মানুষটির। এদিকে, ঘনিষ্ঠ মহল সূত্রের খবর, ঐন্দ্রিলার মৃত্যুর খবর জানার পর থেকেই জল পর্যন্ত খাননি সব্যসাচী। একফোঁটা চোখের জলও ফেলেননি।

ঐন্দ্রিলার জীবনের শেষ সময়টুকু পর্যন্ত তাঁর হাতটা শক্ত করে ধরে থাকা এই ছেলেটিকে কুর্নিশ জানাচ্ছে গোটা বাংলা। সকলেই মনে করছেন, সত্যিই যদি সব্যসাচী ‘স্বার্থপর‍‍’ হন, তবে এমন ‍‍‘স্বার্থপর‍‍’ ভালোবাসার মানুষ যেন সকলেই তাঁদের জীবনে চলার পথে পায়।